শেষ কথা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
Shesh Katha Story by Ravindranath Tagore
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা শেষকথা নামে ছোট গল্পটি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। বিভিন্ন কলেজের এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্স সিলেবাসে এবং বাংলা এম এ সিলেবাসে শেষকথা গল্পটি অন্তর্ভুক্ত আছে। যেসব ছাত্রছাত্রী বাংলা অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করছি কিংবা বাংলাতে মাস্টার্স ডিগ্রী করছে, তাদের উপকারের জন্য শেষকথা গল্প থেকে এই নোটটি তৈরি করেছি।
প্রশ্ন: শেষ কথা গল্পের বিষয়বস্তু আলোচনা করে এই গল্পে আধুনিকতার যে ছোঁয়া আছে এবং নারী শক্তির জয় ঘোষিত হয়েছে তা আলোচনা করো।
'শেষকথা' রবীন্দ্রনাথের শেষ পর্বের গ্রন্থ 'তিনসঙ্গী'র দ্বিতীয় গল্প। মননশীলতা, ইতিহাস চেতনা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও বস্তুনিষ্ঠা এই পর্বের গল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে আখ্যান বিরলতা, চরিত্রের স্বল্পতা, সংলাপের প্রাচুর্য, ভাষার সূক্ষ্ম কারুকার্য ও ব্যঞ্জনাধর্মীতা গল্পের আঙ্গিকে অভিনবত্ব এনেছে।
জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, প্রুস্ত প্রমূখ গল্প উপন্যাস ও কথাসাহিত্যের ধারাকে আমূল বদলে দিয়েছিলেন। কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি পত্রিকার নবীন লেখকরা যুগ যন্ত্রণাকে, উপগ্রহ বাস্তবতা ও নগ্ন-যৌনতাকে গল্পে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। নবযুগের এই সাহিত্যাদর্শ রবীন্দ্রনাথকে নাড়া দিয়েছিল। তবে তাতে রবীন্দ্রনাথের নিজস্ব সাহিত্য ধারায় কোন মৌলিক পরিবর্তন আসেনি।
শেষকথা গল্পের চরিত্রগুলির পরিচয়:
'শেষকথা'র প্রধান চরিত্র তিনটি- নায়ক ও বক্তা চরিত্র নবীনমাধব সেনগুপ্ত, নায়িকা অচিরা এবং তার দাদু অধ্যাপক অনিলকুমার সরকার। এছাড়া আছে পরোক্ষে উল্লিখিত দুটি চরিত্র- অচিরার প্রতারক প্রেমিক ভবতোষ এবং নবীনের বন্ধু বঙ্কিম। পুরুষ চরিত্র দুজনেই বিজ্ঞানী। আর তিনটি প্রধান চরিত্র পরিচয়ে সমাজবদ্ধ মানুষের সাথে নয়, স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ব্যক্তি চরিত্র। এরা কেউ নিছক বাঙালি নয়, এরা দেশকাল নিরপেক্ষ সার্বভৌম মানুষ।
শেষকথা গল্পের বিষয়বস্তু:
শেষ কথা গল্পের কথাবস্তু এই- বিপ্লবী নবীন শাসক ইংরেজের চোখ এড়িয়ে আফগানিস্তান হয়ে আমেরিকা পাড়ি দেয়। যন্ত্র বিদ্যা শিখতে ফোর্ডের কারখানায় অংশগ্রহণ করে। তা ছেড়ে নয় বৎসর খনিজ বিদ্যা শিখতে লাগলো। পাশ্চাত্যের নানা কেন্দ্রে ঘুরে হাতে-কলমে বিদ্যা আয়ত্ত করল। ভালো ডিগ্রিও পেল। দেশে ফিরে ছোটনাগপুরের এক রাজার স্টেটে জিওলজিক্যাল সার্ভে কাজ নিল। তখন তার বয়স 36 বছর। নবীনমাধব দীর্ঘকায়, বলিষ্ঠ, পরিশ্রমী। মায়ের অনুরোধ বা পাত্রীপক্ষের উপরোধে সে কান দেয় নি। সে কর্মযোগী, সে সন্ন্যাসী।
তনিকা নদীর ধারে শাল বীথিকায় নবীন একদিন অচিরাকে আবিষ্কার করল। কুড়িয়ে পেল একটা ছেঁড়া খাম। নবীন বুঝল খামের মধ্যে একটি ট্রাজেডির ক্ষতচিহ্ন লুকিয়ে আছে। তাতে লেখা প্রাপকের নাম, ভবতোষ দত্ত, আইসিএস, ছাপরা। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বন্ধুর কাছে চিঠি দিয়ে সে ভবতোষ এর খবর নিল।
কৃতি অধ্যাপক অনিলকুমার এর সংসার আলো করেছিল তার নাতনি অচিরা। শয়তান ভবতোষ সেই স্বর্গলোকে ঢুকলো। বিবাহ সম্বন্ধ পাকাপাকি হওয়ার পর সে অধ্যাপকের টাকায় বিলাত গেল। আইসিএস হয়ে ফিরে এসে এক উচ্চপদস্থ আমলার মেয়েকে বিয়ে করল। লজ্জায়, ক্ষোভে অধ্যাপক কাজ ছেড়ে নাতনিকে নিয়ে নিরুদ্দিষ্ট হলেন। সব জেনে নবীনমাধব অচিরাকে এই লজ্জা ও অবসাদ থেকে উদ্ধারের সংকল্প নিল। প্রথম আলাপের মধ্য দিয়ে শেষ হলো তার প্রথম বড়দিন।
গল্পের আদিপর্ব শেষ হলো। ছোটগল্পে আদি-অন্ত পর্বের মধ্যে বেশি ব্যবধান থাকে না। বুদ্ধিমতী অচিরা বুঝতে পেরেছে নবীন মাধব ও তার বিজ্ঞান সাধনা এক এবং সে তা দেশকে উৎসর্গ করেছে। বিলেতে বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গিনী ক্যাথরিন তার জীবনসঙ্গিনী হতে চেয়েছিল। কিন্তু দেশের জন্য সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি নবীনমাধব।
অচিরা জানে, মেয়েদের জীবনের চরম লক্ষ্য ব্যক্তিগত, আর পুরুষের লক্ষ্য নৈব্যক্তিক। দেবযানী চেয়েছিল কচকে ব্যক্তি প্রেমের নিগড়ে বাঁধতে। কচ চেয়েছিল সেই বাঁধন কেটে অমর লোকের পথ বানাতে। মেয়ে পুরুষের এই দ্বন্দ্বে নবীনমাধব জয়ী হয়েছে। আজ অচিরারপ্রার্থনা, জয় হোক আপনার পৌরুষের।
লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন এই অরণ্য প্রকৃতির মধ্যে দুজনে একটা অন্ধ প্রবৃত্তির অস্তিত্ব অনুভব করল। তারা দুজনে এই দুর্বলতাকে জয় করতে চায়। নবীন জানতে চায় অচিরার মন কি ভবতোষ থেকে সরে এসেছে এবং তার মূলে কি নবীনের কোন ভূমিকা আছে? অচিরা স্বীকার করলো নবীন এবং বনের ভিতরকার অন্ধ শক্তি সম্মিলিতভাবে তার মনকে দুর্বল করে ফেলেছে।
এভাবে হেরে যেতে সে লজ্জা বোধ করছে। ভালোবাসা সে পূজা বলে জানে এবং এই পূজাতে নারীর সতীত্ব। ভবতোষকে তখন সে আর শ্রদ্ধা করেনা, তার কাছে ফিরে যাবার প্রশ্নই নেই। ব্যক্তি ভবতোষ আর অচিরার প্রথম ভালোবাসা এক নয়। অচিরার ভালোবাসা নৈব্যক্তিক। এখন তার কোন আধারের দরকার নেই।
নবীনের এখানকার খনিজ অনুসন্ধানের কাজ শেষ হয়েছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাকে দূরে যেতে হবে। যাবার আগে সে অচিরার শেষ কথাটা শুনতে চায়। দূর থেকে অচিরা নবীনকে বিজ্ঞানের তপস্যা করতে দেখেছে, তাকে ভক্তি করেছে। পরিচয় ঘনিষ্ঠ হতে সে নবীনের মধ্যে তপস্যা ভঙ্গের ইঙ্গিত পেয়েছে।
এর জন্য মনে মনে নিজেকে ধিক্কার দিয়েছে। নিজের মধ্যেও প্রবৃত্তি রাক্ষসের অস্তিত্ব অনুভব করেছে। অচিরা জানে তপস্যার মধ্যে দিয়ে মানুষের সত্য অভিব্যক্ত হয়। তপস্যার দ্বারা স্থূলতা বর্জন করে মানুষ দেবতা হয়ে ওঠে। এই দেবত্ব অর্জন থেকে বিজ্ঞান সাধক নবীনকে সে ভ্রষ্ট করতে চায় না। এই তার শেষ কথা।
নিজের জীবনের বঞ্চনা ও দুঃখ মোচনের জন্য সে তার জ্ঞানতাপস দাদুকে অধ্যাপনার বৃহৎ কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। এখন তার প্রতিকার করতে চায়। দাদুকে অধ্যক্ষের পদ গ্রহণের জন্য সেক্রেটারি অনুরোধ জানিয়েছিলেন। দাদু সেই চিঠি লুকিয়ে রেখেছিল। এখন অচিরা born teacher সেই দাদুকে তার যথার্থ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা দেখতে চায়। মহৎকে মহত্তর হবার আদর্শে প্রাণিত করাতেই যথার্থ নারী শক্তির জয়। এটি গল্পটির মর্মবাণী।
রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প
বাংলা ছোটগল্প
বাংলা গল্প
গল্পগুচ্ছের গল্প
বাংলা প্রেমের গল্প
আধুনিক বাংলা গল্প
বাংলা অনার্স নোটস
বাংলা নোটস
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam links in the comment box.