প্রশ্নঃ বাংলা নাট্যসাহিত্যে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান আলোচনা করো। Place of Dinabandhu Mitra in Bengali Literature.
![]() |
DINABANDHU MITRA বাংলা নাটকে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান |
DINABANDHU MITRA বাংলা নাটকে দীনবন্ধু মিত্রের অবদান
পাশ্চাত্যধর্মী বাংলা নাটকে প্রথম সার্থক পুরুষ মাইকেল মধুসূদন দত্ত হলেও তখনও তিনি পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক পরিবেশ ছেড়ে দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতায় নেমে আসতে পারেননি।
কিন্তু দীনবন্ধু মিত্র নাট্য প্রতিভার বিচারে মধুসূদনের সমধর্মী না হয়ে তাঁর নাটকে কঠোর-বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলিকে প্রথম থেকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। মানব জীবন সম্পর্কে তীক্ষ্ণ বোধ ও বস্তুগত চেতনা তাঁর নাটকগুলিকে সার্থক করে তুলেছে।
ডাক বিভাগের কর্মী হওয়ায় তাঁকে বাংলা ও বাংলার বাইরে ঘুরতে হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবন সম্পর্কে বিপুল অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তিনি।
এ ছাড়া তিনি ছিলেন হাস্য পরিহাস প্রিয়। তাই অভিজ্ঞতা ও সাহিত্য প্রতিভা মিলিত হয়ে তার নাটকগুলিকে করেছে উজ্জ্বল।
দীনবন্ধু মিত্রের নাটকগুলি Dinabandhu Mitra Books
দীনবন্ধু মিত্র সাতটি নাটক ও প্রহসন লিখেছিলেন। ‘নীলদর্পণ’(১৮৬০), ‘নবীন তপস্বিনী’(১৮৬৩), ‘কমলে কামিনী’(১৮৭৩)- এই তিনটি তাঁর গভীর রসের নাটক।
আর চারটি প্রহসন হল ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’(১৮৬৬), ‘সধবার একাদশী’(১৮৬৬) ‘লীলাবতী’(১৮৬৭), ‘জামাই বারিক’(১৮৭২) । এর মধ্যে ‘সধবার একাদশী’ তাঁর ও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক।
নীলদর্পণ নাটক Nildurpan by Dinabandhu Mitra
‘নীলদর্পণ’ নাটকে বাংলা সাহিত্যে দীনবন্ধু প্রথম আবির্ভাব। তখন বাংলাদেশে নীলকর সাহেবদের চূড়ান্ত অত্যাচারের পর্ব চলছে। ইংরেজ নীলকরেরা তাদের লোভ চরিতার্থ করতে গ্রামে-গ্রামে ভালো-ভালো জমিগুলিকে চিহ্ন দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে নীলচাষ করাচ্ছে।
কোন প্রতিবাদে ফল হয়নি, বরং দারোগা ও ম্যাজিস্ট্রেটদের সাহায্যে তারা গরীব কৃষকদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালাচ্ছিলেন। 24-পরগনা, নদীয়া, যশোহর, হুগলি, হাওড়া ইত্যাদি নিম্নবঙ্গের জেলাগুলিতে এই অত্যাচার বীভৎস রূপ ধারণ করে
তাদের হাতে দরিদ্র রায়ত ও মধ্যবিত্ত গৃহস্থরা সর্বস্বান্ত হয়েছিল। এই অত্যাচারের কথা সারা দেশের শিক্ষিত সমাজের কাছে জানানোর জন্য হরীশ মুখোপাধ্যায় যেমন তাঁর ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় সংবাদগুলি তুলে ধরতেন, তেমনি দীনবন্ধু সেই সমস্যাকে তুলে ধরেছেন তার ‘নীলদর্পণ’ নাটকে।
এই নাটক প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের মত সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। অন্য প্রাদেশিক ভাষাতেও এর অনুবাদ হল। এর একটি ইংরেজি অনুবাদ করলেন সম্ভবত, মধুসূদন। এই অনুবাদটি প্রকাশ করলেন পাদ্রী জেমস লং। ইংরেজি অনুবাদ বইটি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পৌঁছে গেল।
ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে ইন্ডিগো-কমিশন বসিয়ে ও আইন-এর সাহায্যে এই অত্যাচার হ্রাস করার চেষ্টা করলেন। এতসব আলোড়নকারী ঘটনা ঘটলো দীনবন্ধুর নীলদর্পণকে নিয়ে। তাই বাংলার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে এর বিশেষ মূল্য স্বীকার করতে হবে।
একদা আমেরিকার দাস প্রথার বিরুদ্ধে ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’(১৮৫২) উপন্যাস লিখে শ্রীমতি স্টো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন এবং আইন করে দাস প্রথা বন্ধের মাধ্যমে বেঁচে গিয়েছিল নিরীহ দাসেরা, তেমনি এই ঘটনার সাথে ‘নীলদর্পণ’ একই মর্যাদায় যুক্ত।
তাই বঙ্কিমচন্দ্র নীলদর্পণকে বাংলায় ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’ বলেছেন। প্রকৃত অর্থে এটি গণনাট্য, যেখানে এই প্রথম বাংলা নাটকের দরিদ্র মানুষ ও তাদের ব্যথা-বেদনা, চোখের জলকে তুলে ধরা হয়েছে।
সরকারি কর্মচারী হওয়ায় নাটকটি তিনি স্বনামে মুদ্রিত করতে পারেননি। তাই ‘কেনাচিৎপথিকেনাভি প্রণীতং’এই ছদ্মনামে নাটকটি লেখেন। ‘নীলকর বিষধর দংশন কাতর’ প্রজাদের কষ্টের কথা এই নাটকে আছে। এর ইংরেজি অনুবাদ ‘Nildurpan or Indigo Planting Mirror’।
তবে নাটক হিসাবে ‘নীলদর্পণ’ খুব একটা ভাল হয়নি। অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা সমূহ, আত্মহত্যা, নারী নির্যাতন- এসবের উৎকট বাড়াবাড়ি নাটকটির ট্র্যাজিক রসকে করেছে। তাছাড়া এই নাটকে ভদ্র চরিত্রের সংলাপ এতোই কৃত্রিম যে, শুধু সংলাপের ব্যর্থতাতেই নাটকটি ব্যর্থ হয়েছে।
তবু, নাটক হিসাবে ‘নীলদর্পণ’ সার্থক না হলেও বাংলার সমাজ আন্দোলনের ইতিহাসে এর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।
দীনবন্ধুর প্রহসন: Farce by Dinabandhu Mitra
দীনবন্ধুর প্রতিভা প্রহসনকালের প্রতিভা। গুরুগম্ভীর নাটকে তাই তিনি বিশেষ সুবিধা করতে পারেননি। তাঁর দুখানি রোমান্টিক নাটক ‘নবীন তপস্বিনী’ ও ‘কমলে কামিনী’ সেই কারণেই ভালো হয়নি; যেন অনেকটা প্রাণহীন দুর্বল রচনা।
বরং পার্শ্বচরিত্রগুলি তাদের হাস্য পরিহাস জন্য কিছুটা হলেও মূল চরিত্র ও নায়ক-নায়িকা নিদারুণভাবে ব্যর্থ। মনে হয়, বাস্তব জীবন ও চরিত্রাঙ্কনে দীনবন্ধু যতটা সফল, কাল্পনিক রোমান্টিক কাহিনী সৃজনে তিনি ততটই ব্যর্থ।
দীনবন্ধুর খ্যাতি প্রহসন গুলির জন্য। এক বৃদ্ধের বহু-বিবাহের আকাঙ্ক্ষা ও বিবাহের আসরে বিরম্বনা নিয়ে দমফাটা হাসির নাটক ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’। আবার, ধনী সমাজে ঘরজামাই রাখার প্রথাকে হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে নিদারুণভাবে ব্যঙ্গ করা হয়েছে ‘জামাই বারিক’ প্রহসনে।
তাঁর ‘লীলাবতী’ হল কলকাতার শহরতলীর বাস্তব জীবনচিত্রকে নিয়ে লেখা প্রহসন। শহুরে সভ্যতাকে হাস্য-পরিহাস-এর মধ্য দিয়ে ব্যঙ্গ করেছেন তিনি। তবে প্রহসন হিসেবে রচনাটি ব্যর্থ হয়েছে।
সধবার একাদশী
দীনবন্ধু শ্রেষ্ঠ রচনা ‘সধবার একাদশী’। এই প্রহসনটি অসাধারণ সাহিত্য গুণে যেমন দীনবন্ধুকে অমর করেছে তেমনি বাংলা প্রহসনের জগতে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা লাভ করেছে। উনিশ শতকের কলকাতার ইংরেজি শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেকেরই বারাঙ্গনা গমন, ইংরেজি বুলির খৈ ফোটানো, অথচ অন্তঃসারশূন্যতার এক সুনিপুণ কাহিনী চিত্র তুলে ধরেছেন ‘সধবারএকাদশী’তে।
একেই কি বলে সভ্যতা
এই ধরনের নকশা জাতীয় রচনা, যেগুলি গদ্যে-পদ্যে ও নাটক আকারে রচিত হয়েছিল উনিশ শতকে, সেগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলো দীনবন্ধুর রচনাটি। এটি প্রহসন হলেও চরিত্রের দিক থেকে নাট্যধর্মী। মধুসূদনের ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ প্রহসনের আদর্শে এটি পরিকল্পিত হলেও অপেক্ষাকৃত উন্নত রচনা।
এখানে শুধু ইয়ং-বেঙ্গল সম্প্রদায়ের উৎশৃংখলাকেই দেখাননি তিনি, এখানে একটি নাটকের মতো কাহিনীর ধারাবাহিকতা আছে। মূল চরিত্র নিমচাঁদ দত্তের সুখ-দুঃখ, মাতলামির নানা হাস্যকর ঘটনা এতে বর্ণিত। উচ্চশিক্ষিত, আদর্শবাদী নিমচাঁদ শুধু সংযমের অভাবে কিভাবে জীবনের সবকিছু নষ্ট করেছে সেটাই হাসি-ঠাট্টার আড়ালে করুণ সুরে বেজে উঠেছে। উনিশ শতকের যুবকদের ব্যর্থতা যেন নিমচাঁদ-এর মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। নিমচাঁদ যেন মুখের হাসি দিয়ে চোখের জলকে আড়াল করেছে।
বাংলা নাটকের শ্রেষ্ঠ শিল্পী না হয়েও অপার সহানুভূতি, জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা ও তৎকালীন গ্রাম বাংলার এক জ্বলন্ত সমস্যাকে তুলে ধরে দিনবন্ধু বাংলার সমাজ ও সাহিত্যের যে উপকার সাধন করেছেন, সে কথা চিরস্মরণীয়।
AKB SCHOOL provides Madhyamik Bengali Suggestion, WBBSE Class 10th Bengali Question Answer Suggestion, WBBSE Class 10th Bengali Question Paper, WBBSE Madhyamik important question-answers, Madhyamik Bengali Suggestion, Bengali Honours Notes, WBCHSE Class 12th suggestions, WBCHSE HS question answers.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam links in the comment box.