ফসিল
সুবোধ ঘোষ
Fossil by Subodh Ghosh
প্রশ্ন: সুবোধ ঘোষের লেখা ফসিল গল্পের বিষয়বস্তু এবং নামকরণ সার্থকতা আলোচনা করো। (Bengali Short Story Fossil by Subodh Ghosh)
বাংলা ছোটগল্পে সুবোধ ঘোষের একটি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ক্ষেত্র আছে। কতকটা আবিষ্কারকের চোখ দিয়ে জীবনের এক একটি খন্ডাংশ তিনি বেছে নিয়েছেন। তারপর ওই খন্ডাংশের মধ্যে জীবনের কোনো গভীরতর সত্যকে রূপ দিয়েছেন।
সমাজ ব্যবস্থা ও মানব মনের গোপন প্রদেশের বহু অজ্ঞাত তথ্য ও রহস্য উদঘাটিত করে গল্পকার সুবোধ ঘোষ জীবনের সত্য পরিচয় তুলে ধরেছেন। বাংলা ছোটগল্পে তার অনেক গল্পের মধ্যে তিনটি গল্প অবিস্মরনীয়- 'অযান্ত্রিক', 'পরশুরামের কুঠার', এবং 'ফসিল'। এরমধ্যে 'ফসিল' সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্প।
ফসিল গল্পের বিষয়বস্তু: (Fossil by Subodh Ghosh)
অঞ্জনগড় নেটিভ স্টেট- ইংরেজদের করদ রাজ্য। আয়তন সাড়ে আটষট্টি বর্গমাইল। মহারাজা ত্রিভুবনপতি, ধর্মপাল ও অরাতিদমন। রাজ্য ছোট হলেও আছে সচিবোত্তম, ফৌজদার, ন্যায়াধীশ, কোতোয়াল এবং ফৌজ। পুরনো কেল্লাটি এখন হতশ্রী। কেল্লার ফটকে দুটো মরচে পড়া কামান। দপ্তরে দপ্তরে পাগড়ী আর তরবারির ঘটা। রুক্ষ পাথুরে জমি আর পাহাড়।
দূর থেকে জল এনে জমি সেচ দিতে হয়। সামান্য ভুট্টা, জব আর জানার ফলে। ফসলের অর্ধেক রাজকর চাষিরা দিতে চায়না। তখন তসিলদার সেপাই ডেকে তাদের দমন করে। প্রজারা ভিল ও কুর্মী। অর্ধেক প্রজা মরিশাসে চিনির কলে কাজ নিয়ে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছেড়েছে। ভীলেরা দলে দলে ধাঙড় রিক্রুটার ক্যাম্পে নাম লিখিয়ে নানা শহরে চলে গেছে।
দেশের সঙ্গে নাড়ির টান কুর্মী প্রজারা ছিঁড়তে পারেনা। তারা চাষ করে, বিদ্রোহ করে, মার খায়। মহারাজার দয়া ধর্ম আছে। প্রতি রবিবার সহস্রাধিক দুস্থকে দরবার থেকে চিঁড়ে ও গুড় দেওয়া হয়। মহারাজার জন্মদিনে রামলীলা গান হয়। প্রজারা নিমন্ত্রণ পায়। তবে সুখে-দুঃখে বিপদে সম্পদে যেখানে জমায়েত, সেখানেই লাঠি চলে। লাঠিতন্ত্র রাজ্যশাসনের মূল নীতি।
রাজকোষাগারের দৈন যখন চরমে উঠলো তখন ল এজেন্ট হয়ে এল সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমান, সাহসী ও কল্যাণব্রতী মুখার্জি সাহেব। এজেন্ট সাহেব যেমন কড়া, তেমনি দয়ালু। প্রজারা তাকে ভয় পায়, ভক্তিও করে। মুখার্জির আদেশে লাঠিবাজি বন্ধ হল। প্রতিটি দপ্তর অডিট করা হলো। জমি জরিপ করা হলো।
অঞ্জনগড়ের উন্নতি তার দিবারাত্রির স্বপ্ন। মুখার্জি একদিন আবিষ্কার করল অঞ্জনগড়ের খনিজ সম্পদ। গ্রানাইট স্তরের খাঁজে খাঁজে অভ্র আর এসবেসটসের স্তুপ। কলকাতার মার্চেন্টেরা লাখ লাখ টাকায় গড়ের জমি ইজারা নিল। মুখার্জি অঞ্জনগড়ের রূপ বদলে দিল। মার্চেন্টরা একজোট হয়ে মাইনিং সিন্ডিকেট করল।
তৈরি হল বিশাল মার্বেল প্যালেস। গ্যারেজ ভরে গেল দামি মোটর গাড়িতে। বিদ্যুতের পাওয়ার হাউস বসলো। খনি অঞ্চলে বড় বড় রাস্তা, কুলির ধাওড়া, পাম্প বসানো ইঁদারা, বাংলো, ক্লাব, বাগান, জিমখানা গড়ে উঠলো। অঞ্জনগড়ের মানচিত্র নিয়ে বসলো মুখার্জি। তার ইরিগেশন স্কিমকে বাস্তবায়িত করতে হবে। অঞ্জনা নদীর সমস্ত জল জমির ভিতর দিয়ে বয়ে যাবে। কুর্মীরা মাথাপিছু তিনকাঠা জমি পাবে। তারপর একটা ব্যাংক, টেনারী ও কাগজের মিল করতে হবে। তারপর একটা স্কুল।
এখান থেকে সংঘাতের শুরু। মহারাজার প্রবল আপত্তি। কারণ হিসাবে দেখালেন দুখানা চিঠি। একটির লেখক কুর্মী সমাজের পক্ষে দুলাল মাহাতো। মহারাজার আইনসঙ্গত পণ্যের অতিরিক্ত ফসল তারা দেবে না। দ্বিতীয় চিঠিটি সিন্ডিকেটের পক্ষে মি. গিবসনের। রাজার পেয়াদারা খনির ভিতরে ঢুকে চারজন কুলিকে ধরে নিয়ে গেছে। একাজ অধিকার ভঙ্গের শামিল। তারা এর মীমাংসা চায়।
দুলাল মাহাতো বহুদিন পরে মরিসাস থেকে ফিরেছে। সে কুর্মীদের জীবনে চাঞ্চল্য এনেছে, প্রতিবাদের সাহস এনেছে। শক্তিমান রাজা আর শোষক সিন্ডিকেটকে বিশ্বাস নেই। দুলাল কুলি ও চাষীদের শিখিয়েছে সব নগদ নগদ চাই। একহাতে মজুরি আর একহাতে সেলাম। দুলালের ডাকে কুর্মীরা জঙ্গলে সভা করল। তারা মন্ডল প্রতিষ্ঠিত করল।
তার নেতৃত্বে কুর্মীরা প্রতিজ্ঞা করল, যারা তাদের পেটে ও ইজ্জতে হাত দেবে, তাদের সঙ্গে কোন আপোষ নেই। মহারাজার কানে খবর গেল। ক্রুদ্ধ রাজা দুলালকে ডেকে পাঠিয়ে তার অনুমতি ছাড়া খনিতে কুলির কাজ নিষিদ্ধ করে দিলেন। মহারাজ সিন্ডিকেটকে কুলি নিয়োগে তার অবগতির কথা জানিয়ে দিলেন। দু'পক্ষ মহারাজের আদেশ অমান্য করল।
মুখার্জী নিজে দুলালের ঘরে গিয়ে দেখা করল। সেরা যার প্রতি ভক্তি দেখালেও নিজের দাবি থেকে সরে এলো না। মুখার্জি গিবসনের সঙ্গে দেখা করল। তিনি নির্যাতিত মানুষের পক্ষ নিয়ে সওয়াল করলেন। ক্ষুব্ধ মুখার্জি হতাশ হয়ে ফিরে এলো।
সিন্ডিকেট চায় না মুখার্জির ইরিগেশন বাস্তবায়িত হোক। তারা কুর্মীদের নেতা দুলালকে পোষা বিড়াল বানিয়েছে। তাদের ব্যবসার জন্য কুলি দরকার। আর প্রতিবাদী কুর্মী নেতা মাহাতোকে গিবসন কিনে ফেলেছে। তাকে দিয়ে দিল্লিতে মহারাজার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ পত্র পাঠানো হলো।
সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের অশুভ আঁতাত: (Bengali Short Story Fossil by Subodh Ghosh)
এই সময় দুটি দুর্ঘটনা মহারাজ ও সিন্ডিকেট দু'জনকেই বিপদে ফেলল। 14নং পিটের ছাদ ধ্বসে পড়েছে, নব্বই জন কুলি চাপা পড়েছে। আর ফরেস্ট রেঞ্জারের গুলিতে 22 জন কুর্মী মারা গেছে। অঞ্জ অসহায় কুর্মীদের মৃত্যু শাসক রাজা ও শোষক বণিক শক্তিকে মিলিয়ে দিল। মুখার্জির পরামর্শে দুলালকে ধরা হলো।
সামন্ততন্ত্র ও ধনতন্ত্রের মধ্যে অশুভ আঁতাত গড়ে উঠলো। নিহত শ্রমিকদের সঙ্গে দুলালের মৃতদেহ মাটিতে চাপা পড়ে গেল। হয়তো লক্ষ লক্ষ বছর পরে কোন জাদুঘরে এইসব দেহ ফসিল হয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের বহু কৌতুহলী প্রশ্নের উত্তর দেবে।
বাংলা আধুনিক ছোটগল্প
আধুনিক বাংলা ছোটগল্প
বাংলা গল্প
Bengali Short Story Fossil by Subodh Ghosh
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam links in the comment box.