বাংলা সাহিত্য আলোচনা । নীলদর্পণ । দীনবন্ধু মিত্র । নীলদর্পণ Nil Darpan or The Indigo Planting Mirror by Dinabandhu Mitra
![]() |
নীলদর্পণ Nil darpan or the Indigo Planting Mirror |
প্রশ্ন : 'নীলদর্পণ' নাটকের অতিনাটকীয়তা বিচার করো ।
বা, 'নীলদর্পণ'-এর গঠনগত ত্রুটি-দুর্বলতা বিচার করো ।
বা, 'নীলদর্পণ'-এর সমাপ্তি অংশের শিল্পগুণ বিচার করো ।
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটির শিল্প সার্থকতা বিচার করতে গিয়ে সমালোচকরা নানাবিধ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন । নাটকের সমাপ্তি অংশে যে ঘটনা বিন্যাস আছে তা যথেষ্ট নাট্যরীতি অবলম্বন করে গড়ে ওঠেনি । পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পর্বাঙ্কের ঘটনাগুলি গতি সম্পন্ন হলেও নাটকীয় বিন্যাসের কার্যকারণ সূত্রের সম্পর্কের অবকাশ নেই । বাংলা নাট্য সাহিত্যের প্রথম দিকে এজাতীয় নাটক লেখার প্রবণতা দেখা যেত । এই শ্রেণীর নাটকগুলি উদ্দেশ্যমূলক এবং ঘটনা ছিল শ্বাসরোধকারী উত্তেজনাকর ।
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিয়েছে এবং লেখক উদ্দেশ্যের কথা গোপন না করে ভূমিকাপত্রে তা প্রকাশ করেছেন । এ নাটকে যে সময় সীমা চিহ্নিত হয়েছে তা গুরুত্বপূর্ণ । সে যুগের মানুষের বিশেষত, গ্রামবাংলার দীন দরিদ্র রায়তদের উপর অকথ্য অত্যাচার এ নাটকের প্রধান বিষয় ।
ইংরেজ শাসন ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে একশ্রেণীর লোভী ইংরেজ নীলকর সাহেব অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল, সেটিকে চিত্রিত করাই এ নাটকের প্রধান বিষয়বস্তু। নীলকররা রায়তদের জমিতে চিহ্ন দিয়ে নীল চাষের হুকুম দিয়ে যেতেন । একে বলা হতো ‘মাত্রা করা’ । এরপর জমির মালিক ও কৃষক প্রজাদের নীলকুঠিতে ধরে নিয়ে এসে জোর করে তাদের দিয়ে দাদন লিখে নেওয়া হতো ।
একবার দাদন নিলে রায়তদের আর কষ্টের সীমা থাকতো না । আর দাদন নিতে অস্বীকার করলে যে অত্যাচার করা হতো রাতে বহু পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে মারা যেত । এই ভয়াবহ অবস্থাটি দীনবন্ধুর মনকে ব্যথিত করেছিল । তিনি ‘নীলকরনিকরকরে’ নীলদর্পণ অর্পণ করে আশা করেছিলেন এবার তাদের ললাটে বিরাজমান স্বার্থপরতা-কলঙ্কতিলক তারা বিমোচন করবেন এবং নিরাশ্রয় প্রজাদের মঙ্গল হবে ।
এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য এ নাটকে যে ঘটনা বিন্যাস করা হয়েছে তা যথেষ্ট পরিমাণে সেন্টিমেন্টাল বা আবেগবহুল । এই আবেগকে প্রকাশ করার জন্য এবং আবেগকে রক্ষা করার জন্য লেখক যে নাট্যরীতি অবলম্বন করেছেন প্রাথমিকভাবে সেটা অতিনাটকীয় রীতি।
নাটকের ক্ষেত্রে কার্যকারণ সূত্র অতিক্রম করা অনুচিত । নাটকের কাহিনী চরিত্রানুগ এবং চরিত্র কাহিনীভিত্তিক হওয়া প্রয়োজন । নাট্যকার যে কাহিনী বিন্যাস করেন তার মধ্যে প্রতিটি ঘটনা পরবর্তী ঘটনার জন্য অপেক্ষমান এবং পূর্ববর্তী ঘটনার ফল হিসাবে উপস্থিত হয় । এই যুক্তি সূত্র না থাকলে নাটককে অতিনাটক বা মেলোড্রামা বলা হয় ।
অতিনাটকের ক্ষেত্রে এই কার্যকারণ সূত্রের সম্পর্ক প্রায় থাকে না । সেখানে চরিত্র হয়ে ওঠে আরোপিত ও অবিশ্বাস্য । সম্ভাব্যতা অপেক্ষা বক্তব্যনির্ভর হয় ও আবেগমূলক হয় । এই নাটকে পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দৃশ্যের কাহিনী তীব্র গতি লাভ করেও অবিশ্বাস্য ঘটনা পরম্পরা সৃষ্টি করেছে । ফলে, কাহিনী ও চরিত্র উভয় ক্ষতি হয়েছে ।
অন্তত দুই জাতীয় ঘটনা ঘটেছে পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে । সাধুচরণ-এর সংলাপের মধ্য দিয়ে আমরা জেনেছি যে, নবীনমাধব প্রতিবাদ করেছেন । সাধুচরণ বলেছেন, “তোরাপ গোলের মধ্যে পৌঁছিবামাত্র ছোটসাহেব পতিত বড় বাবুর উপর এক তলোয়ারের কোপ মারে, তোরাপ হস্ত দিয়া রক্ষা করে, তোরাপের বামহস্ত কাটিয়া যায়, বড়বাবুর বুকে একটু খোঁচা লাগে ।”
এখানে দুই বিবাদমান পক্ষ পরস্পরের সামনাসামনি হয়েছে । নবীনমাধব তোরাপের সহযোগিতায় উড ও রোগ সাহেবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছেন । অথচ এরকম একটি দ্বন্দ্বময় নাটকীয় ঘটনা প্রত্যক্ষভাবে ঘটানো হয়নি বলে এই দৃশ্যে নাটকীয় ন্যায় রক্ষিত হয়নি । কারণ, নাটকের মূল ঘটনা বা ক্লাইম্যাক্স এই জাতীয় পরোক্ষ উক্তির সাহায্যে প্রকাশ করা নাটকীয় বাস্তবতার ও যুক্তি শৃঙ্খলার অভাবকে সূচিত করে ।
দ্বিতীয় ঘটনা ঘটেছে মুখ্যত, পঞ্চম অঙ্কের তৃতীয় ও চতুর্থ গর্ভাঙ্কে । তৃতীয় গর্ভাঙ্কে আমরা দেখেছি সাধুচরণ-এর কন্যা ক্ষেত্রমনী নীলকরদের অত্যাচারে মারা গেছে । এ সময় বেশ কিছু পরোক্ষ উক্তির সাহায্যে ঘটনাটি বিবৃত হয়েছে । মা রেবতীর হাহাকারের মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পেরেছি, ক্ষেত্রমনীর মৃত্যু হয়েছে ।
“মুই সোনার নক্কি ভেসয়ে দিতি পারব না মা রে, মুই কনে যাব রে- সাহেবর সঙ্গি থাকা যে মোর ছিল ভাল মা রে, মুই মুখ দেখে জুড়োতাম মা রে, হো, হো, হো ।” এই ক্রন্দন ও মায়ের অন্তর-জ্বালা দর্শকেরর মনকে বিশেষভাবে স্পর্শ করে । কিন্তু ঘটনাটি প্রত্যক্ষ ঘটানো হলে এটি আরও নাটকীয় হয়ে উঠতো ।
তা সত্বেও ক্ষেত্রমনীর মৃত্যু অতিনাটকীয় নয় এবং অবাস্তব, অবিশ্বাস্য, অতিনাটকীয় ঘটনাবলী এই দৃশ্যে অনেকটা কম । ক্ষেত্রমনীর উপর অত্যাচার, তোরাপের ও নবীন মাধবের সক্রিয় প্রতিবাদ অনেকটাই বাস্তবসম্মত । ক্ষেত্রমনীর মৃত্যু সেই কারণে যতই পরোক্ষ কথনের জন্য কম গতিসম্পন্ন হোক, তা নাট্যরীতি লঙ্ঘন করেনি ।
পঞ্চম অঙ্কের চতুর্থ গর্ভাঙ্কে পরপর কয়েকটি মৃত্যু আছে । দৃশ্যটির সূচনা ঘটেছে নবীনমাধবের মৃতদেহ কোলে নিয়ে সাবিত্রীর আর্তনাদের মধ্য দিয়ে । সাধুচরণের কথায় জেনেছি, “একে পতিশোকের ব্যাকুলতা তাহাতে পুত্র মৃতবৎ, ক্ষিপ্রতার ক্রমশ বৃদ্ধি হইতেছে, বোধ হয় কত্রী ঠাকুরানীর নবীনের অগ্রেই পরলোক হইবে ।“
ধীরে ধীরে সাবিত্রী উন্মাদিনী হয়ে গেছে । এ সময় সরলতা এসেছে এবং সাবিত্রী তাকে গলায় পা দিয়ে হত্যা করেছে । কিছুক্ষণ পরে সাবিত্রীর উন্মাদনা কমেছে এবং সরলতার মৃত শরীর দেখে নিজের কৃতকর্মের জন্য মৃত্যুবরণ করেছে । পরপর ঘটে যাওয়া দুটি মৃত্যু অতিশয় আরোপিত ও কার্যকারণ সূত্র সম্বন্ধ বিরুদ্ধে । তাই অতিনাটক হিসাবে এই অংশটি গ্রহণ করা অনিবার্য ।
দীনবন্ধু মিত্র শিল্পের জন্য শিল্প রচনা করেননি । তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর নাট্যকলার মাধ্যমে সাধারণকে সচেতন করতে এবং তাঁর প্রয়াস অবশ্যই সফল হয়েছিল । বাংলাদেশে আর কোন নাট্যকার এই জাতীয় গণ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত নাটক এত সফলভাবে রচনা করেন নি ।
তিনি কাহিনীর মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করা অপেক্ষা আবেগের উপর অধিক দৃষ্টিপাত করেছেন এবং সে আবেগকে দর্শক সাধারণের মনে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন । সে চেষ্টা সফল হয়েছে । তবু মৃত্যুর বাহুল্য বিশেষভাবে এই কাহিনীকে মেলোড্রামার দিকে ঠেলে দিয়েছে । তাই নিরপেক্ষ বিচারের নীলদর্পণকে ত্রুটিযুক্ত বলতেই হয় ।
বাংলা সাহিত্য আলোচনা । নীলদর্পণ । দীনবন্ধু মিত্র ।
Related Tags:
Nil Darpan upsc
Nil Darpan summary
Nil Darpan characters
Nil Darpan highlighted the pitiable condition of
Nil Darpan natok english anuvad kare ke
Nil Darpan written by
who wrote Nil Darpan in english
Nil Darpan bengali
Nil Darpan natok
Nil Darpan ke lekhak
Nil Darpan natok bengali pdf
Nil Darpan natak
who translated Nil Darpan in english
who was sentenced for english translation of Nil Darpan
Nil Darpan
Bengali Literature
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam links in the comment box.