মেঘদুত (Meghdoot)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Ravindranath Tagore)
Meghdoot Poem by Ravindranath Tagore: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'মেঘদূত' কবিতার কাব্যসৌন্দর্য বিশ্লেষণ:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'মেঘদূত' (Meghdoot) কবিতাটি বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। মেঘদুত কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা মানসী কাব্যের কবিতা। 'মেঘদূত' কবিতাটির ইতিহাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, " এখানকার লাইব্রেরীতে একখানা মেঘদূত আছে, ঝড়-বৃষ্টি দুর্যোগ, রুদ্ধদ্বার গৃহ প্রান্তে তাকিয়া আশ্রয় করে দীর্ঘ অপরাহ্ণে সেইটি সুর করে পড়া গেছে, কেবল পড়া নয় সেটার উপরে ইনিয়ে বিনিয়ে বর্ষার উপযোগী একটি কবিতা লিখেও ফেলেছি। "
প্রশ্ন: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'মেঘদুত' কবিতাটির কাব্যসৌন্দর্য বিশ্লেষণ কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা মেঘদূত' কবিতাটি একটি প্রেম ও বিরহের কবিতা। কালিদাসের মেঘদূত' কাব্য পড়তে পড়তে কাব্যের যক্ষের বিরহ ব্যাকুলতা কবির মনকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। কালিদাসের মেঘদূত' কাব্য রবীন্দ্রনাথের মনকে বারবার আকর্ষণ করেছে। অলংকার শাস্ত্র অনুসারে মেঘদূত' কাব্যটি ক্লাসিক কাব্য। এই কাব্যের মধ্যে শৃঙ্গার রস ও করুণরস মিশ্রিতভাবে আছে।
কবিতাটি বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই এই কবিতায় তিনটি পর্যায়ে আছে। কবিতার প্রথমে আছে, মধ্যযুগের রীতি অনুসারে অগ্রজ কবির প্রতি বন্দনা ও প্রশংসা।
"কবিবর, কবে কোন বিস্মৃত বরষে
কোন পুন্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলেন মেঘদুত। মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আঁধার স্তরে স্তরে
যখন সংগীত মাঝে পুঞ্জীভূত করে।"
মেঘদূত' কবিতার দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখতে পাই, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছবি এবং কাব্যের বিষয়বস্তু বর্ণনা। রবীন্দ্রনাথ সময়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে কালিদাসের কালে অভিসার করেছেন।
"ছিন্ন করি কালের বন্ধন
সেইদিন ঝরে পড়েছিল অবিরল
চিরদিবসের যেন রুদ্ধ অশ্রুজল
আর্দ্র করি তোমার উদার শ্লোক রাশি।"
রবীন্দ্রনাথের লেখা মেঘদূত' কবিতার মধ্যে কালিদাসের কাব্যের যক্ষের বিরহ সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। মেঘের সঙ্গে ভাসতে ভাসতে কবির মন গতিশীল হয়েছে। কালিদাসের মেঘদূত' কাব্য রবীন্দ্রনাথকে রোমান্টিক জগতে নিয়ে গেছে। এই কবিতায় একদিকে যেমন কালিদাসের প্রতি রবীন্দ্রনাথের প্রীতি প্রকাশ পেয়েছে তেমনি ভাবে মেঘদূত' কাব্যের পুনর্মূল্যায়ন করেছেন তিনি।
কালিদাসের মেঘদূত' কাব্য লেখার পরে অনেক বছর কেটে গেছে। কিন্তু প্রতি বর্ষায় মেঘদূত' কাব্য যেন চিরন্তন প্রেম ও বিরহে মানুষের মনকে পরিপূর্ণ করে তোলে। যারা বহু বছর ধরে সঙ্গীহীন এবং প্রিয়তমের সান্নিধ্য থেকে দূরে থাকে তারা নিজের হৃদয়ের বেদনাকে খুঁজে পায় মেঘদূত' কাব্যের মধ্যে।
বিরহী যক্ষ আম্রকূট পর্বতে নির্বাসিত। বর্ষার সজল মেঘ আকাশে ভেসে চলেছে। যক্ষ মেঘকে দূত করে তার বিরহিনী প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছেন। মেঘের সাহায্য নিয়ে তিনি তার অন্তরের বেদনা তার প্রিয়তমার কাছে উপস্থাপন করেছেন। এই কাহিনী পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের মন কালিদাসের কাব্যগ্রন্থ অনুসরণ করে দেশ দেশান্তরে উড়ে গেছে।
"সানুমান আম্রকূট, কোথা বহিয়াছে
বিমল বিশীর্ণ রেবা বিন্দ্যপাদমূলে
উপলব্যথিতগতি, বেত্রবতীকূলে
পরিণত ফল শ্যামজম্বু বনচ্ছায়ে"
বিরহী যক্ষের বিরহিনী প্রিয়া রয়েছে দর্শান গ্রামে। সেই গ্রামটি কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা। পথের পাশে গাছে গাছে পাখিরা বাসা বেধেছে। বনাঙ্গনারা অজানা কোন নদীর তীরে বিহার করছিল-
"তপ্ত কপোলের তাপে ক্লান্ত কর্ণোৎপল
মেঘের ছায়ায় লাগি হতেছে বিকল।"
মেঘ উড়ে চলার সময় জনপদের বধূকে দেখেছে। সেই নববধূ এখনো ভ্রূভঙ্গী শেখেনি। আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘের দেশে যাওয়া দেখতে দেখতে তার মন আনমনা হয়ে ওঠে। কবি এর সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন সিদ্ধাঙ্গনার কথাকে।
রাত্রিবেলা উজ্জয়িনী নগরের বর্ণনা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
"সেথা নিশি দ্বিপ্রহরে
প্রণয়চাঞ্চল্য ভুলি ভুবনশিখরে
সুপ্ত পারাবত"
ঠিক একইভাবে বিরহে জর্জরিত রমণী প্রেমের অভিসারে যাত্রা করে। এরপরে মেঘ উড়ে চলল কুরুক্ষেত্রের ওপর দিয়ে। কামনার মোক্ষধাম অলকায় মেঘ ছাড়া আর কেউ যেতে পারে না। কামনার মোক্ষধাম অলকায় চির বসন্ত বিরাজ করে, চির আনন্দ ভরা সেই স্থান।
"শয্যা প্রান্তে লীনতনু ক্ষীণশশীরেখা
পূর্ব গগনের মূলে যেন অস্তপ্রায়"
কবিতাটির প্রথম অংশে এবং শেষ অংশে বিরহ বেদনার কথা আছে। কালিদাসের কাব্যে যে পূর্ব মেঘের কথা আছে, তা রবীন্দ্রনাথ কয়েকটি স্তবকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এই বর্ণনা নিরস নয়। এর সঙ্গে কবি নিজের ব্যক্তিগত অনুভব মিশিয়ে দিয়েছেন। কালিদাসের কাব্যের নায়িকা রবীন্দ্রনাথের কবিতায় হয়ে উঠেছে চিরন্তন বিরহ বেদনার প্রতীক।
কবিতার একেবারে শেষ অংশে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত অনুভব প্রকাশ পেয়েছে। তিনিও যে বিরহী এবং প্রেমের পিপাসী তা এই অংশে প্রকাশ পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের মেঘদূত' কবিতা কালিদাসের কাব্যের বিরহ আরো ব্যাপকভাবে অভিমূর্ত হয়েছে।
কবিতাটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা। যদিও এখানে অন্তঃঅনুপ্রাস এর ব্যবহার ঘটেছে। অমিত্রাক্ষর ছন্দ এবং অন্তমিল এই কবিতার প্রেমের ভাবনাকে সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছে। কবিতার শেষে আছে
"কে দিয়েছে হেন শাপ, কেন ব্যবধান?
কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ?
কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ?"
এই চরণগুলির দ্বারা প্রেমের ট্রাজেডি সুন্দর ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। মানুষ জীবনে যা কিছু চায়, সব পায়না। এই অপ্রাপ্তি আমাদের মনে বেদনার সৃষ্টি করে। অপ্রাপ্তির সেই বেদনা মেঘদূতের বেদনার সঙ্গে এক হয়ে যায়। এভাবে সুন্দর ভাষা ভঙ্গিমায় মেঘদুত কবিতায় ট্রাজেডি প্রকাশ পেয়েছে তেমনি এর কাব্যগুণ প্রশ্নাতীত সৌন্দর্য লাভ করেছে।
Related Tags:
মেঘদূত কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মেঘদূত প্রবন্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর Meghdoot by Rabindranath Tagore Meghdoot by Rabindranath Tagore Meghdoot poem by Rabindranath
Meghdut poem by Ravindranath Tagore
#meghdoot-ravindranath-tagore
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam links in the comment box.