বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রাচীন যুগ শিবায়ন কাব্যধারা Bangla Sahityer Itihas Shivayan Kavyadhara
![]() |
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রাচীন যুগ শিবায়ন কাব্যধারা Bangla Sahityer Itihas Shivayan Kavyadhara |
এই সময়পর্বেই পৌরাণিক দেবতা শিবের কিছুটা স্থূল, লোকায়ত রূপ কল্পনা করে এক জাতীয় কাব্য লেখা হয়েছিল, যেখানে পূজা প্রাপ্তির অভিলাষে দেবতা কর্তৃক মানুষকে ভয় প্রদর্শন বা প্রলোভন দেখানোর বর্ণনা পাই না; বরং হর-পার্বতী সংসার জীবনের বর্ণনা অনেকটা মঙ্গলকাব্যের ধাঁচে বর্ণিত হয়েছে ।
শিব এখানে কৃষিজীবী ও ভোগ পরায়ন গৃহী । এই ধরনের কাব্যকে শিবায়ন কাব্য বলা হয় । পণ্ডিতদের মতে, শিবায়নের শিব চরিত্রটির মূল আছে বৈদিক দেবতা রুদ্রের মধ্যে । কারো মতে, দ্রাবিড় সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটেছে । বস্তুত, শিবায়নের শিব এক মিশ্র দেবতা ।
শংকর কবিচন্দ্র
শংকর কবিচন্দ্র সপ্তদশ শতকের শিবায়ন কাব্য ধারায় স্মরণীয় হয়ে আছেন । বিষ্ণুপুরের ব্রাহ্মণ বংশে তাঁর জন্ম । তাঁর শিবায়ন কাব্যের সম্পূর্ণ পুথি পাওয়া যায়নি । তবে, মৎস্য ধরা পালা ও মাখনলাল মুখোপাধ্যায় উল্লিখিত শঙ্খ পড়া পালাটি তাঁর রচনা বলে জানা যায় । মৎস্য ধরা পাঠটি শিবায়নের লোকপ্রচলিত কাহিনীর প্রথম লিখিত রূপ মনে হয় । ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তিনি শিবায়ন রচনা করেছিলেন । উল্লিখিত পালাদুটিতে শ্রীকবি শংকর, কবি শংকর, কবিচন্দ্র প্রভৃতি ভনিতা পাওয়া গেছে । কিষান ও জালিক শিবের চরিত্র বর্ণনায় কবি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন ।
রামকৃষ্ণ রায়
সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে রামকৃষ্ণ রায় শিব বিষয়ক নানা পৌরাণিক আর লৌকিক আখ্যান অবলম্বনে সুবৃহৎ শিবমঙ্গল কাব্য রচনা করেন । বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে শিব প্রসঙ্গের এমন নিপুণ সংকলন বাংলা সাহিত্যে আর নেই । তাই এই গ্রন্থকে শিব বিষয়ক কোষগ্রন্থ বলা হয় । রামকৃষ্ণ শিবায়ন কাব্যে শিবের পৌরাণিক মহিমা বর্ণনাতেই আবদ্ধ থাকতে চেয়েছেন । মাত্র একটি পালায় শিবের লোকায়ত বর্ণনা আছে । মঙ্গলকাব্যকে গ্রাম্যতা বিমুক্ত করে পুরাণের সীমায় উত্তীর্ণ করতে চেয়েছিলেন তিনি । রামকৃষ্ণের নিবাস হাওড়া জেলার রসপুর গ্রামে ।
কবির পিতামহ জয়চন্দ্র পাঠান আমলে ‘রায়’ উপাধি লাভ করেছিলেন । গ্রন্থের ভাষা মার্জিত, চরিত্রের পারম্পর্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে রামকৃষ্ণের শিবমঙ্গল প্রশংসনীয় । পৌরাণিক ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত থাকার কারণে ও আদিরসের ব্যবহার না থাকার কারণে রামকৃষ্ণের কাব্য জনপ্রিয় হয়নি । দীনেশচন্দ্র সেন ও আশুতোষ ভট্টাচার্যের উদ্যোগে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে রামকৃষ্ণের কাব্য প্রকাশিত হয়েছে ।
রামেশ্বর ভট্টাচার্য
রামেশ্বর ভট্টাচার্য শিবায়ন কাব্য ধারার সবচেয়ে খ্যাতিমান কবি । রামেশ্বর ভট্টাচার্য শিবায়ন ছাড়া সত্যপীরের পাঁচালির রচয়িতা ।মেদিনীপুরের ঘাটালের অন্তর্গত যোধপুর গ্রামের শান্ডিল্য গোত্র উদ্ভূত বন্দোপাধ্যায় বংশে জন্ম হয় তাঁর । যজন-যাজন এর জন্য ভট্টাচার্য পদবী গ্রহণ করেন । ডক্টর পঞ্চানন চক্রবর্তীর মতে কবির জন্ম ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে ও মৃত্যু ১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ।
রামেশ্বরের উপাধি ছিল কবি-কেশরী । তাঁর শিবকীর্তন কাব্যে সাতটি পালা আছে । প্রথম থেকে তৃতীয় পালার মাঝামাঝি পর্যন্ত পৌরাণিক কাহিনীর প্রাধান্য । প্রকাশক পঞ্চানন চক্রবর্তীর মতে পুরান কাব্যের বিশেষ বৈচিত্র নাই । কিন্তু, লৌকিক অংশে শিবের গার্হস্থ্য জীবন, দারিদ্র, কলহ প্রভৃতি বর্ণনা বাস্তবানুগ হয়েছে । তবে কাব্যটি সর্বদা স্নিগ্ধ নয় । মনে হয়, কাব্যটি অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে লেখা হয়েছিল।
মৃগলুব্ধ
শিবায়ন কাব্যের দুটি ধারা; একটি শিবায়ন ও অন্যটি মৃগলুব্ধ উপাখ্যান । মৃগলুব্ধ কাব্যের সংখ্যা দুটি- একটি দ্বিজ রতিদেবের ‘মৃগলুব্ধ’, অন্যটি রামরাজার ‘মৃগলুব্ধ সংবাদ’। আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ ১৩২২ বঙ্গাব্দে কাব্যদুটি প্রকাশ করেন । রতিদেব চট্টগ্রামের সুচক্রদণ্ডী গ্রামে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন । কাব্যে আছে-
“রস অংক বাউ শশী শাকের সময় ।
তুলা মাসে সপ্তবিংশতি গুরুবার হএ ।।”
অর্থাৎ, ১৫৯৬ শকে বা ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে রতিদেবের কাব্য লেখা হয়েছিল ।
সুকুমার সেনের মতে, রামরাজার প্রকৃত নাম শিশুরাম রায় । করিম সাহিত্যবিশারদের মতে কবি মগ বংশের মানুষ । রতিদেবের কাব্যের সাথে রামরাজার কাব্যের অনেক মিল আছে । কবি ভনিতায় লিখেছেন, “শংকর কিংকর রামরাজা” । মৃগলুব্ধ আখ্যানকাব্য বিচারে বিশেষ উল্লেখযোগ্য নয় । শিবকাহিনী একমাত্র শিবায়ন কাব্যেই সাহিত্যগুণ সম্পন্ন হয়েছে । অষ্টাদশ শতকের পরবর্তী সময়ে আর কোন শিবায়ন কাব্য লেখা হয়নি ।
ঋণ স্বীকার- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় .
বাংলা সাহিত্য আলোচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রাচীন যুগ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam links in the comment box.