Footer Logo

২০২১/০৬/০১

Adab (Aadaab) by Samaresh Basu

  BAIRAGYA SHIKSHA NIKETAN       ২০২১/০৬/০১

 আদাব
সমরেশ বসু


বিংশ শতকের চতুর্থ দশকে যে কথা সাহিত্যিকগণ আবির্ভূত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সমরেশ বসু (Samaresh Basu) তাদের অন্যতম। পরিচয় পত্রিকায় 1946 খ্রিস্টাব্দে শারদীয় সংখ্যায় সমরেশ বসুর (Samaresh Basu) আদাব (Adab) গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। আদাব গল্প প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠক ও সাহিত্যিক সমাজে বিশেষভাবে সাড়া পড়ে গিয়েছিল। 

Adab (Aadaab) by Samaresh Basu
Adab (Aadaab) by Samaresh Basu

Bengali Story Adab (Aadaab) by Samaresh Basu


আদাব গল্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:


সমরেশ বসুর (Samaresh Basu) লেখা আদাব (Adab) গল্পের একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। এর প্রেক্ষাপটে রয়েছে হিন্দু ও মুসলমানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই গল্পের জন্ম হয়েছে এক অস্থির সময়ে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের কিছুদিন আগে কলকাতা  শহরে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে নারকীয় হত্যালীলা ঘটেছিল। আদাব গল্পে সেই হত্যালীলার করুন ছবি ফুটে উঠেছে। দাঙ্গাকে দমন করার জন্য কলকাতা শহরে 144 ধারা কারফিউ অর্ডার জারি হয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমান দুটি সম্প্রদায়ের মানুষরা এই প্রাণঘাতী দাঙ্গার বলি হয়েছিলেন।


1939 সেপ্টেম্বর মাস থেকে 1945 সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (Second World War) বিস্তৃত হয়েছিল। পরপর দুটি যুদ্ধের অভিঘাতে সারাবিশ্বে নৈতিক ও বিশ্বাসের সংকট ও অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছিল। এই সময় ভারতে ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি আন্দোলন চূড়ান্ত বেগ অর্জন করেছিল।


উপায় না দেখে চতুর ইংরেজ ডিভাইড এন্ড রুল নীতির প্রয়োগে ভারতবাসীকে দুর্বল করে শাসনের অধিকার বজায় রাখার জন্য যে দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রয়োগ করেছিলেন তার বিষময় ফল এই কালে ফলতে শুরু করেছিল। 1946 খ্রিস্টাব্দে বাংলার মুসলমানরা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেন। তার পরিনামে সারা ভারত রক্তাক্ত হয় এবং রক্তস্নাত হয়ে বাংলাদেশে মানব সভ্যতার চরম ক্লেদাক্ত অভিব্যক্তির প্রকৃষ্ট প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিতে আদাব গল্পটি লেখা হয়েছে। 


আদাব গল্পের গঠন শিল্প:


আদাব গল্পে সমরেশ বসুর (Samaresh Basu) ভূমিকা সর্বজ্ঞর। কিন্তু গল্পটি বিবরণ ধর্মী নয়। এমনকি আখ্যানধর্মীতা এর চরিত্র বৈশিষ্ট্য নয়। গল্পটির প্রধান বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা। মাঝে মাঝে বিবৃতি ও পরিবেশ ব্যাখ্যান থাকলেও এই গল্পের প্রধান দুটি চরিত্র নিজেদের কথা আর কাজে চতুর্মাত্রিকতা পেয়েছে। গল্পের চরিত্রের কোন নাম নেই। এই নামহীনতা লেখকের গভীর চিন্তার পরিচয় দেয়। গল্পের মধ্যে যে পরিচয় ফুটে উঠেছে তা থেকে জানতে পারি এই দুটি চরিত্রের একজন সুতা কলের হিন্দু শ্রমিক, আর অপরজন বুড়িগঙ্গার মুসলমান মাঝি। লেখক যে নাম দেননি তার কারণ এরা বিশেষ ব্যক্তি নয়, এরা প্রতিনিধি। দাঙ্গাকবলিত বিপন্ন মানুষের প্রতিনিধি এরা। 


আদাব গল্পের বিষয়বস্তু:


গল্পের সূচনায় দাঙ্গাকবলিত শহরের বর্ণনা দিয়েছেন লেখক। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, দলবদ্ধ আক্রমণ ছাড়াও চলছে গুপ্তঘাতকের অব্যর্থ হানা। সংকটকে তীব্রতর করেছে সুযোগসন্ধানী লুটেরাদের আত্মপ্রকাশ। গাড়ির শব্দ, বুটের আওয়াজ, গুলির শব্দ- আবহাওয়া থমথমে। এমন সময় উল্টানো ভাঙ্গাচোরা ডাস্টবিনের মধ্যে প্রাণ রক্ষার জন্য আশ্রয়ে সন্ধানী দুটো মানুষের দেখা হয়।


সেই দেখা হবার মুহূর্ত থেকে দুটো মানুষ পরস্পরকে সন্দেহ করতে থাকে। চার চোখে উত্তেজনা জাগে আর হৃদয়ের স্পন্দন হয় তালহারা। উভয়েই উভয়ের কাছ থেকে আক্রমণের প্রতীক্ষায় রুদ্ধশ্বাস হয়ে থাকে। কিন্তু আক্রমণ ঘটে না। সন্দেহে দুলতে দুলতে তারা পরস্পরের পরিচয় জেনে নেয়। কিন্তু ধর্ম পরিচয় অকথিত থাকে। 

এমন সময় ধারেকাছে দাঙ্গাকারীদের উন্মত্ত কোলাহল শোনা যায়। আতঙ্কগ্রস্থ মাঝি অন্যত্র সরে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সুতা কলের শ্রমিক উঠতে বারণ করে। সময় এত বিপন্ন, কাল এত কুটিল যে এই শুভ আবেদন সন্দেহের সঞ্চার করে মাঝির মনে। সুতা কলের শ্রমিকের মনেও সন্দেহের বীজ বপন হয়। সে স্পষ্টতই বলে ওঠে, তার অপর সঙ্গী দল ডেকে হত্যার পরিকল্পনা করছে না তো! সরল মাঝির সত্তায় আঘাত লাগে। সে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, "এইটা কেমুন কথা কও তুমি?"


সুতা মজুরের উত্তরে আশ্বস্ত হলো মাঝি। সুতা মজুর নিরাপত্তাহীনতাকে বুঝতে পেরে বলে, "তুমি চইল্যা গেলে আমি একলা থাকুম নাকি?" মুহূর্তে ঝলসিত হয় এক মহান সত্য, মানুষের উন্মত্ত হানাহানি, ক্লিন্ন পরিবেশেও মানুষ মানুষকেই চায়। "মানুষের মন চায় মানুষের মন"। বস্তুতপক্ষে আদাব হল সর্বধ্বংসী বিকৃত জীবন বিরোধী অন্ধ নিষ্ঠুরতার সামনে দাঁড়িয়ে মূক জনগণের অবিচল মানবিকতায় স্থিতির কাহিনী।


ক্রমে সুতা মজুর জানতে পারে মাঝে মুসলমান। আতঙ্কে সে বলে, "... তুমি...?" আর মাঝি সতেজ কন্ঠে বলে, "হ আমি মোছলমান।... কী হইছে?" তার উত্তেজনা মজুরের মনে ভয় সঞ্চার করে। সে বলে ওঠে, " কিছু হয় নাই কিন্তু..." সেই কালবেলাতে দাঁড়িয়ে সুতা মজুরের চোখ যায় মাঝির বগলের পুঁটুলিতে। মাঝি ব্যাখ্যা দেয় আগামীকাল ঈদের জন্য সে তার ছেলে মেয়ের জন্য জামা কাপড় কিনেছে।


তবুও সন্দেহের ঘুন পোকা কুরে কুরে খায় মজুরকে। সে না বলে পারেনা, " আর কিছু নাই তো? " মাঝি পুঁটুলি এগিয়ে দেয়, অপ্রস্তুত সুতা মজুরকে বলতেই হয়, "আরে না না ভাই দেখুম আরকি।" এবার মাঝির পালা। সময়ের সন্দেহের বিষ তার ধমনীতেও জ্বালার উদ্রেক করে। সে বলে ওঠে, "দেহই ভাই, তুমি কিছু রাখ টাখ নাই তো?" এভাবে সেই নিবিড় অন্ধকারে ডাস্টবিনের ডাস্টবিনের নোংরা পরিবেশে নীরব ধূমপানের মধ্য দিয়ে তারা বিশ্বাসের ভীত তৈরি করে। 


এবার শুরু হয় দুজনের আলাপ। আলাপ অগ্রসর হবার সঙ্গে সঙ্গে দোষারোপের প্রসঙ্গ উঠে আসে। সুতা কলের মজুর দোষ চাপায় মুসলিম লীগের উপর। আর মাঝি কটূক্তি করে বলে ওঠে, "হেই সব আমি বুঝি না। আমি জিগোই মারামারি কইরা হইব কী?" এইখানে মজুরের অনুভূতিও একতালে এসে মেশে। সে কুণ্ঠাহীন ভাবে বলে, "হইব আর কী, হইব আমার এই কলাটা"। নেতারা সাত তলার উপরে পায়ের উপর পা রেখে হুকুম জারি করে। "আর হালার মরতে মললমা আমরাই"। মানুষের এই অবনমনে, প্রাণের এই মূল্যহীনতায় মাঝির কোথায় ভেসে ওঠে- "মানুষ না, আমরা য্যান কুত্তার বাচ্ছা হইয়া গেছি"


আবার ভারী বুটের শব্দ শোনা যায়। পুলিশের মার এড়াতে তারা পালিয়ে যায় দক্ষিনে। মাঝির একমাত্র আকুতি বাদামতলীর ঘাটে কোনক্রমে পৌঁছতে পারলে সাঁতার দিয়ে বুড়ি গঙ্গা পার হয়ে চারদিন যাবৎ বিচ্ছিন্ন স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে মিলিত হতে পারবে। ঈদের সকালে সে হাসি ফোটাতে পারবে তার বিবি ও সন্তানদের মুখে। পথের ধার ঘেঁষে চলতে চলতে তারা পৌঁছে যায় ইসলামপুরের ফাঁড়ির কাছে। মাঝির কথা ভেবে মজুরের মুখ শুকিয়ে যায়।


মাঝির কামিজ চেপে ধরে আশঙ্কায় বলে ওঠে, "যদি তোমায় ধইরা ফেলায়?" আত্মবিশ্বাসী মাঝি অভয় দিয়ে এগিয়ে যায়। আর যাবার আগে বলে, " যাই... ভুলুম না ভাই এই রাত্রের কথা। নসিবে থাকলে আবার তোমার লগে মোলাকাত হইব। আদাব। " মজুরও প্রত্যাভিবাদন জানায় "আদাব"। এই আদাব প্রথা মাত্র নয়, এক মানুষের অন্তর্গত মনুষ্যত্বকে অপর এক মানুষের সশ্রদ্ধ স্বীকৃতিদান মাত্র। 


মাঝি পা টিপে চলে। মজুরের প্রার্থনা, "ভগবান মাঝি য্যান বিপদে না পড়ে"। তার চোখে স্বপ্ন ঘনায়। সে দেখতে পায় দুঃস্বপ্নের অবসানে এক পুনর্মিলিত দম্পতির আনন্দমুখর মিলন দৃশ্য। হঠাৎ শোনা যায় হল্টের হুকুম, "ডাকু ভাগতা হ্যায়"। এই উচ্চকিত ঘোষণায় মজুরের বুক কেঁপে ওঠে। রাত্রির নিস্তব্ধতা ভেঙে অফিসারের আগ্নেয়াস্ত্র দুবার গর্জে ওঠে। সে যেন শুনতে পায় এক স্নেহ ব্যাকুল সরল মাঝির নৈরাশ্যদীর্ণ হাহাকার, "দুশমনরা আমারে যাইতে দিল না তাগো কাছে"। এই উক্তির মধ্য দিয়ে সমব্যথী বন্ধুর প্রতি সুতা মজুরের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে। 


আদাব গল্পের নামকরণ:


আদাব গল্পে সমরেশ বসু (Samaresh Basu) দাঙ্গা বিধ্বস্ত সময়ে সাধারণ মানুষের অন্তর ধর্মের পরিচয় দিয়েছেন। সাধারণ মানুষ দাঙ্গা চায়না। মানুষ চায় শান্তিতে সুখে থাকতে। তাই আদাব শব্দটি সাধারণ মানুষের মনকে সুন্দর ভাবে প্রকাশ করেছে। গল্পটির নামকরণ দুটি সাধারণ মানুষের প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই এর নামকরণ সার্থক হয়েছে। 


ছোট গল্প হিসেবে আদাব:


ছোটগল্পের পরিণাম নানাভাবে হতে পারে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Narayan Gangopadhay) ভাষায় ছোটগল্পের একটি পরিণতি হলো চাবুক হাঁকড়ানো পরিনাম। আদাব গল্পের শেষ পরিণতি এমনই চাবুক হাঁকড়ানো। কাজেই তা শিল্প সুন্দর।


Aadab by Samaresh Basu

Adab by Samaresh Basu

Bengali Story

Bengali Short Story

Samaresh Basu Short Story

Samaresh Basu Bengali Short Story Adab

আদাব গল্পের কেন্দ্রীয় বিষয় কী

আদাব গল্পের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

আদাব গল্পের নামকরণের সার্থকতা

আদাব গল্পের বিষয়বস্তু


logoblog

Thanks for reading Adab (Aadaab) by Samaresh Basu

Previous
« Prev Post

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Please do not enter any spam links in the comment box.