ইঁদুর
সোমেন চন্দ
সোমেন চন্দের (Somen Chanda) লেখা ইঁদুর (Rats / Indur) গল্পটি বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। ইঁদুর গল্পটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা অনার্সের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত আছে। যেসব ছাত্রছাত্রী বাংলা অনার্স নিয়ে পড়াশোনা করছে কিংবা বাংলা এমএ করছে এই নোটটি তাদের উপকার করবে। বাংলা সাহিত্যের রস পিপাসু মানুষদের রস পিপাসা চরিতার্থ করার জন্য এটা আমার ছোট্ট প্রয়াস।
সোমেন চন্দের লেখা ইঁদুর গল্পের বিশ্লেষণ
Somen Chanda Short Story Rats
সোমেন চন্দের জীবন (Somen Chanda):
শ্রমজীবী ও সর্বহারা আন্দোলনের এক তরুণ সৈনিক পরাধীন ভারতের নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সোমেন চন্দের (Somen Chanda) জীবনটা ছোট গল্পের মত, যাকে শ্রমজীবী আন্দোলন করার অপরাধে নিষ্ঠুর ঘাতকের হাতে নৃশংসভাবে নিহত হতে হয় মাত্র 21-22 বছর বয়সে। গণ-আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি সোমেন চন্দ সাহিত্য রচনাকে জীবনের উদ্দেশ্য বলে বরণ করেছিলেন। ঢাকা শহরে কমিউনিস্ট পাঠচক্র এবং ঢাকার প্রগতি লেখক সংঘ এর সংগঠক ছিলেন তিনি। সেখানে তিনি তাঁর লেখা গল্পগুলো পাঠ করতেন। সোমেন চন্দ তার জীবনে মাত্র চার, পাঁচ বছর সাহিত্য চর্চার সুযোগ পান। এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি চব্বিশটি ছোট গল্প, দুটি একাঙ্ক নাটক ও তিনটি গদ্যকবিতা রচনা করেন।
ইঁদুর গল্পের পটভূমি:
সোমেন চন্দের (Somen Chanda) লেখা ইঁদুর গল্পটি তার মৃত্যুর কিছু পরে পরিচয় পত্রিকায় 1942 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ 1961 খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে 'শতবর্ষের শত গল্প' নামে গল্প-সংকলনের দ্বিতীয় খন্ড এই গল্পটিকে স্থান দিয়েছিলেন। এই গল্পটি এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে, নানা ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে সাড়া ফেলেছিল সারা দেশে। অশোক মিত্র মহাশয় এটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন।
সোমেন চন্দের লেখা ইঁদুর গল্পের কাহিনী:
গল্পটি উত্তম পুরুষের বাচনভঙ্গিতে প্রকাশিত। গল্পের কথক চরিত্র হলো সুকুমার। সুকুমার এক দরিদ্র নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাদের সংসারের দারিদ্র ও অভাববোধ ততটা প্রকট না হলেও খুব একটা স্বচ্ছলতা ছিলনা। যেন লেখক সোমেন চন্দের (Somen Chanda) ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতা গল্পকথক সুকুমার চরিত্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এই গল্পে দেখি সুকুমার লেখকের মতো সংগঠনের কাজে নেমেছে।
আপাতদৃষ্টিতে গল্পটি খুবই সাদামাটা। এক নিম্নবিত্ত পরিবারে ইঁদুরের অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে গল্পের শুরু। " আমাদের বাসায় ইঁদুর এত বেড়ে গেছে যে আর কিছুতেই টেকা যাচ্ছে না"। স্পষ্টত বোঝা যায় ইঁদুর এখানে এক প্রতীকী চরিত্র হয়ে উপস্থিত হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে অভাব-অনটন, দারিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারে ইঁদুরের মতোই নিত্যসঙ্গী। ইঁদুর যেমন তার ধারালো দাঁত দিয়ে শতছিন্ন করে চলেছে চাল-ডাল আসবাবপত্র, অথচ তাকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না, বরং দিন দিন তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি হচ্ছে, তাদের অত্যাচার বাড়ছে। তেমনি দরিদ্রের গৃহে অভাব অনাহার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। নুন আনতে পান্তা ফুরায় এমন এক অভাবী সংসারে সাক্ষাৎ বিপদ হিসেবে হাজির হয়েছে সেই ইঁদুরের দল। তাকে রোধ করার ক্ষমতা এককভাবে কোনো সুকুমার বা তার মায়ের নেই। কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক সোমেন চন্দ যেন বলতে চেয়েছেন, দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের ওপর নেমে আসা এই অত্যাচার বিচ্ছিন্ন এককভাবে প্রতিরোধ করা যায় না। তার জন্য সকলকে সংগঠিত হতে হবে। ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় এই বিপদকে প্রতিহত করতে হবে। নয়তো "ইঁদুরের অত্যাচার নির্বিবাদে সহ্য করে যাওয়াই ভবিতব্য"। অর্থাৎ গল্পের প্রথমে ইন্দুর দুর্বলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
ইঁদুর গল্পটি একটি প্রতীকী গল্প। ইঁদুরের কাজ মানুষকে ভয় পাইয়ে দেওয়া। এখানেও দেখি সুকুমারের মা ইঁদুরকে ভীষণ ভয় পান। ইঁদুর, কেঁচো, জোঁক, মাকড়সা এরা সবাই দলবদ্ধভাবে ভয়ের বস্তু বলে হাজির হয়। সুকুমারের ভয় জোঁককে, তার বন্ধু ভীম ভয় পায় কেঁচোকে। এসব ছোটখাটো প্রাণীদের সম্মিলিত আক্রমণে দরিদ্রের স্যাঁতসেঁতে ঘরে ভয়ের আবহ সৃষ্টি হয়। হঠাৎ শুধু ইঁদুর নয়, তার সঙ্গী হয়ে আরো অনেকেই ভয় দেখাতে শুরু করে আমাদের। প্রতীকী তাৎপর্যে বলেছেন, "এসব ছোটখাটো ভয়ের মূলে বুর্জোয়া রীতিনীতির কোন প্রভাব আছে কিনা বলতে পারি নে"। নিম্ন মধ্যবিত্তের মানসিক অবস্থাটি এক কথায় স্পষ্ট হয়ে যায় এবং সাধারণ মানুষের মানসিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলিকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা ধরা পড়ে।
অথচ সুকুমারের মা ইঁদুরকে ধরতে পারেন না এবং ধরতে চান না। ইঁদুরের প্রতি এই যে দয়া এটিও মধ্যবিত্ত মানসিকতার বৈশিষ্ট্য। একদিন মায়ের শাড়িতে আটকে যায় ইঁদুর। তবুও মা তাকে মারেন না। অনুভূতিশীল বিবেকবান মানুষ কোন অবস্থাতেই সহজে বিপ্লবের পথে, প্রতিবাদের পথে নামতে চায় না। জীবে দয়া করার নামে আসলে সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এড়িয়ে চলতে চায়। ইঁদুরকে মেরে ফেললে সমস্যার সমাধান হবে। তাকে ছেড়ে দেওয়ার অর্থ পলায়নবাদী মানসিকতা। লেখক বলেছেন এতে সমস্যার সমাধান হয় না, বরং নির্দয়ভাবে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু গল্পের কথক সুকুমারও সেই মধ্যবিত্তের প্রতিনিধি। তাই সমাধানের জন্য কখনো রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও অরবিন্দের উপদেশের আশ্রয় নেয়। যেমন কিনা দরিদ্র পরাজিত হতাশ মধ্যবিত্তরা দেবতা ও দেব্স্থান আঁকড়ে ধরে বাঁচার আশ্রয় হিসাবে।
এভাবে গল্পটিতে বিপ্লবপূর্ব মধ্যবিত্তের মানসিকতা বিশ্লেষণ করে সমস্যার প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছেন। লেখক সোমেন চন্দ এক শোষণমুক্ত সমাজের ছবি আঁকতে চেয়েছেন। গল্পের কথক সুকুমার শেষ পর্যন্ত সব সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে গণসংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং এক বিশ্বাস নিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছে, "সাম্য গর্ব, তার ইস্পাতের মত আশা, তার সোনার মত ফসল বুকে করে আমি ফিরে এলুম"। এখানে গল্পটিতে এক আশার ছবি এঁকে শেষ করেছেন লেখক।
বাংলা সাহিত্য
বাংলা আধুনিক ছোট গল্প
বাংলা গল্প
সোমেন চন্দের বাংলা গল্প
সোমেন চন্দের গল্প
বাংলা অনার্স নোটস
বাংলা এম এ নোটস
ইঁদুর গল্প
সোমেন চন্দের ইঁদুর গল্প
Somen Chanda Short Story Rats
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam links in the comment box.