বাংলা সাহিত্য আলোচনা
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আধুনিক যুগ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
Bengali Literature
Bibhutibhusan Bandyopadhay
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর বাংলা কথাসাহিত্যের সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় । জীবন শিল্পী বিভূতিভূষণ মানুষের জীবন ও বাংলার প্রকৃতিকে তার উপন্যাসে পটভূমি করেছিলেন । ‘সাহিত্যের পথে’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের উপাদান সম্পর্কে লিখেছিলেন, বাংলাদেশের সাহিত্যের উপাদান বাংলার নরনারী, তাদের দুঃখ দারিদ্রময় জীবন,বাংলার ঋতুচক্র,বাংলার সময়কাল, আকাশ-বাতাস, বাঁশবনের, আমবাগানের নিভৃত ছায়ায় ঘেরা ফুল বিছানো পথের ধারে যেসব জীবন অখ্যাতির আড়ালে আত্মগোপন করে আছে, তাদের কথাই বলতে হবে ।
’কল্লোল’, ‘কালিকলম’- এর যুগের মানুষ হয়েও তিনি মানুষের শাশ্বত জীবনবোধকে আশ্রয় করে হয়ে উঠলেন স্বতন্ত্র । তিনি বলেছেন, গাছপাল্ ফুল, পাখি, উদার মাঠ, ঘাট, সন্ধ্যা, জ্যোৎস্না রাত্রি, শত-সহস্র বছর ধরে যে বিরাট অসীম শান্ত উল্লাসের অস্তিত্ব, সাহিত্যিকদের কাজ হচ্ছে এই আনন্দের বার্তা সর্বসাধারণের প্রাণে পৌঁছে দেওয়া ।
বিভূতিভূষণ তাই মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে ছোট ছোট সুখ দুঃখের লীলা চাঞ্চল্যকে নিয়ে শতাধিক ছোটগল্প ও অনেকগুলি উপন্যাস রচনা করলেন । ছোটগল্প নিয়ে তাঁর সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত । পরবর্তী ২৫ বছর ধরে তিনিবিষয় বৈচিত্র্য ও রূপ বৈচিত্রে রসোত্তীর্ণ অসংখ্য গল্প লিখেছেন । তাঁর প্রতিটি গল্পের কেন্দ্রে আছে মানুষ । তাকে আশ্রয় করে কখনো প্রকৃতি, কখনো ঈশ্বর চেতনার প্রকাশ ঘটেছ । পিতার কাছ থেকে তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন গল্প বলার ভঙ্গীটি । তাঁর পিতার পেশা ছিল কথকথা বলা । তাই বিভুষনের গল্পে একটি মনোরম কাহিনী আমরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য করি ।
নানা ধরনের ছোট গল্প লিখেছেন তিনি । তাদের মধ্যে কাহিনী প্রধান গল্পে শুধু কাহিনী নয়, ঘটনা বিন্যাস, উপযুক্ত পরিবেশ রচনার ব্যাপারে তিনি সার্থক । ‘মেঘ মল্লার’(১৯৩১), ‘মৌরিফুল’(১৯৩২), ‘যাত্রাবদল’(১৯৩৪), ‘জন্ম ও মৃত্যু’(১৯৩৭), ‘কিন্নর দল’(১৯৩৮), ‘বেনেগীর ফুলবাড়ী’(১৯৪১), ‘বিধু মাস্টার’, ‘অসাধারণ’(১৯৪৬), এরূপ বহুবিচিত্র গল্প লিখেছিলেন তিনি । তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘তৃণাঙ্কুর’(১৯৪৩) ।
ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক যুগ থেকে কাহিনী নিয়ে লেখা হয় ‘মৌরিফুল’ গল্পটি । তেমনি রোমান্টিক গল্প ‘মেঘমল্লার’ অতিপ্রাকৃত ও অলৌকিক রসের গল্প । তুচ্ছ বিষয়কে মহিমাময় করে লেখা ‘জলসত্র’ গল্পটি তাঁর অসাধারণ রচনা । ছোটগল্পগুলিতে তাঁর পূর্ণপরিচয় নিহিত । মণীন্দ্রলালের প্রভাব থাকা সত্বেও তার প্রথম গল্প ‘উপেক্ষিতা’(১৯২২) সার্থক রচনা ।
‘পুঁইমাচা’ গল্পটিতে তাঁর সর্বাধিক বিখ্যাত উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’র বীজ নিহিত আছে । এই জীবনধারা ভিত্তিক গল্পগুলি, এগুলি চিত্র জাতীয় রচনা নয়, দিনলিপি বা ভ্রমণবৃত্তান্ত নয়, এদের একটা সুনির্দিষ্ট শিল্পরূপ আছে । তাঁর গল্প গঠনের নৈপুণ্য, ঘটনাবিন্যাস, প্লট পরিকল্পনা, চরিত্র ও কাহিনীর মিশ্রণ বাহ্যিকভাবে পাঠকের চোখে পড়বে না ।
অথচ, তাঁর গল্পে যে গভীর ব্যঞ্জনা, জীবন রহস্যের যে তাৎপর্য নিহিত আছে, তা আমাদের মুগ্ধ করে । হয়তো তিনি গল্পের সাজসজ্জার দিকে ততটা নজর দেন নি, যতটা ভেবেছিলেন অন্তরঙ্গ রসসৃষ্টির দিকে ।
তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা 13টি । ‘পথের পাঁচালী’(১৯২৯), ‘অপরাজিত’(১৯৩১), ‘দৃষ্টি প্রদীপ’(১৯৩৫), ‘আরণ্যক’(১৯৩৮), ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’(১৯৪০), ‘বিপিনের সংসার’(১৯৪৪), ‘দেবযান’(১৯৪৪, ‘অনুবর্তন’(১৯৪২), ‘ইছামতি’(১৯৫০)), ‘দুই বাড়ি’, ’হেদার রাজা’, ‘অথৈ জল’, এবং মৃত্যুর পর প্রকাশিত ‘অশনি সংকেত’(১৯৫৯) । তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ ।
‘পথের পাঁচালী’ লেখকের বাল্যস্মৃতিমূলক উপন্যাস চিত্র । তাঁর প্রগাঢ় অনুভূতি ও ভাবুকতা বইটির আখ্যায়িকাগুলিকে রমণীয় করেছে । ‘অপরাজিত’ পথের পাঁচালী’র পরের কথা । এখানে লেখক উপন্যাসের বাঁধা পথ অবলম্বন করে নি । একটি বালক-মন কিভাবে রূপকথার রূপলোকে বিচরণ করতে করতে অগ্রসর হল, বালক থেকে কিশোর, কিশোর থেকে যুবক হল, হারিয়ে গেল তার জন্মভূমি । জীবনের নানা ক্ষয়ক্ষতি সত্বেও তার রূপকথার জগতে হারালো না । তারপর, তার পুত্রের মধ্যেও সেই জীবন প্রতীতি বয়ে চললো । সে কথাই তিনি অসাধারণ শিল্পের দ্বারা ফুটিয়ে তুলেছেন । রোমা রোলাঁর জয়েন্ট Jean Christopheএর সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’র বিশেষ সাদৃশ্য আছে । তিন খন্ডে লেখা এই বৃহৎ উপন্যাস এক আশ্চর্য সৃষ্টি ।
‘আরণ্যক’ উপন্যাসটিতে প্রকৃতি স্বয়ং প্রধান চরিত্র হয়ে উঠেছে যার দৃষ্টান্ত বাংলা সাহিত্যে নেই । প্রকৃতির সাথে মানবমনের যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক, তাকে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন তিনি । ‘ইছামতি’, ‘দেবযান’ এমন আরও উপন্যাসে প্রকৃতি ও ঈশ্বর অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে । বস্তুত, অধ্যাত্ম চেতনা তাঁর উপন্যাসে একটি বড় লক্ষণ । ঈশ্বর কখনো মানব রূপে, কখনো প্রকৃতি রূপে, কখনো মধুর, কখনো নিষ্ঠুর রূপে ধরা দিয়েছে তাঁর কাব্যে । এভাবে বিভূতিভূষণ অনন্য কথাশিল্পীর মর্যাদা লাভ করেছেন ।
ঋণ স্বীকার- অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, পার্থ চট্টোপাধ্যায় .
বাংলা সাহিত্য আলোচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস আধুনিক যুগ
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
Please do not enter any spam links in the comment box.